চ্যাটজিপিটি গণতন্ত্রকে যেভাবে হুমকিতে ফেলতে পারে
ই-মেইল, স্কুল-কলেজের রচনা, নিবন্ধ কিংবা নিত্যদিনের পারস্পরিক যোগাযোগের জন্য আমরা যা কিছু মগজ খাঁটিয়ে লিখি, তার সবই মাত্র সপ্তাহ কয়েক আগে উন্মুক্ত হওয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির চ্যাটবট ‘চ্যাটজিপিটি’র কারণে হুমকির মুখে পড়ে গেছে। প্রযুক্তি কোম্পানি ওপেনএআই-এর বানানো এই চ্যাটবট স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের লিখিত প্রশ্নে এমনভাবে সাড়া দিতে পারে যার ধরন প্রায় মানুষের কাছাকাছি হয়ে থাকে।
কবিতা কিংবা নাটকের চিত্রনাট্য রচনার মতো প্রতিভানির্ভর সৃষ্টিশীল কাজও এই চ্যাটবট দখল করে নিতে পারে—এমনও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে তার চেয়ে আশঙ্কার কথা হলো, চ্যাটজিপিটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য বড় হুমকি হতে পারে। এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গণতন্ত্রের লড়াইয়ে মানুষের জায়গা দখল করবে; আর সেটি করবে ভোটার আকর্ষণের দিক থেকে ততটা নয় যতটা করবে লবিংয়ের দিক থেকে।
চ্যাটজিপিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় কারও হয়ে মন্তব্য তৈরি করতে পারে। স্থানীয় খবরের কাগজে সম্পাদক বরাবর মেইল লিখতে পারে। প্রতিদিন এটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত লাখ লাখ সংবাদ কিংবা নিবন্ধের লিংকে, ব্লগে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টের মন্তব্যের ঘরে নির্দিষ্ট এজেন্ডা ধরে মন্তব্য করতে পারে।
২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে রাশিয়ার সংস্থা রাশিয়ান ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি কোটি কোটি ডলার খরচ করে শত শত কর্মী নিয়োগ করে যেভাবে প্রচারণা চালিয়েছিল, সে ধরনের অর্থ ও লোকবল ব্যয় না করেই চ্যাটজিপিটি একই কাজ করতে পারে।
স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেখা মন্তব্যের উৎপাত নতুন কোনো সমস্যা না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে কনটেন্ট পোস্ট করতে পারে এমন ধরনের বট কিংবা মেশিনের তৎপরতার সঙ্গে মাঝে মাঝেই আমাদের যুঝতে হয়েছে।
ধারণা করা হয়, পাঁচ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশনের কাছে প্রস্তাবিত পক্ষপাতমুক্ত ইন্টারনেট নীতির উপর অন্তত ১০ লাখ স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেখা মন্তব্য জমা পড়েছিল। ২০১৯ সালে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জনগণের কাছে পরামর্শসূচক মন্তব্য আহ্বান করার পর হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির একজন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পরীক্ষামূলকভাবে ১০০১টি মন্তব্য সাবমিট করতে একটি টেক্সট জেনারেশন প্রোগ্রাম ব্যবহার করেছিলেন। ওই সময়টাতে অবশ্য মন্তব্য সাবমিট করাটা নেহাত সংখ্যাধিক্য দেখানোর খেলা ছিল।
এখন প্ল্যাটফর্মগুলোর হাতে ‘সংগঠিত বিশ্বাসযোগ্যতাহীন আচরণ’ শনাক্ত করার এবং সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে ফেলার অনেক উন্নত প্রযুক্তি এসেছে। যেমন ফেসবুক গত এক বছরে এক শ কোটির বেশি ভুয়া অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলেছে। কিন্তু এখন যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে সক্রিয় হচ্ছে তাতে কোন মেসেজটি আসল, অর্থাৎ মানুষের পাঠানো, আর কোনটি স্বয়ংক্রিয় তা বেছে আলাদা করাই কঠিন হয়ে পড়ছে।
আইনপ্রণেতাদের সবার ইনবক্স স্বয়ংক্রিয় কায়দায় ই-মেইল দিয়ে ভরে ফেলা কিংবা সিনথেটিক ভয়েস কল দিয়ে ক্যাপিটল ভবনের সুইচবোর্ড ব্যস্ত রাখার বদলে চ্যাটজিপিটির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যন্ত্র দিয়ে বেছে বেছে টার্গেট করে করে আইনপ্রণেতাদের কাছে বার্তা পাঠানো যাবে এবং নীতি নির্ধারণী ব্যবস্থার দুর্বল দিকগুলো শনাক্ত করে তাঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা যাবে। এর মাধ্যমে জনসংযোগ সংক্রান্ত প্রচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করা যাবে এবং আইনপ্রণেতাদের বিভ্রান্ত করা যাবে।
আমরা মানুষেরা যখন এই কাজগুলো করি তখন সেগুলোকে আমরা বলি ‘লবিং’ বা চেষ্টা তদবিরের মাধ্যমে প্রভাব খাটানো। নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কেতাদুরস্ত ভাষায় মেসেজ লেখা ও সেগুলোকে নিশানা করা ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজের জন্য অনেক পেশাদার সংস্থা পর্যন্ত গড়ে উঠেছে। এখন চ্যাটজিপিটি-সজ্জিত লবিয়িস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যুদ্ধে ব্যবহার্য মনুষ্যবিহীন ড্রোনের মতো প্রচারাস্ত্র প্রয়োগ করবে।
এটি এমন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যা কিনা রাজনৈতিক নেটওয়ার্কগুলোর গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারে। চ্যাটজিপিটির টেক্সচুয়াল জেনারেশন সক্ষমতা ব্যবহার করে এই সিস্টেম কংগ্রেসের সদস্যদের মধ্যে কে কোন নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কতটা প্রভাবশালী; কোন কংগ্রেস সদস্য করপোরেট কর নীতি আর কোন সদস্য সামরিক ব্যয় সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণে প্রভাব খাটাতে সক্ষম—তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বের করে ফেলতে পারে। মানব লবিয়িস্টদের মতোই এই সিস্টেমটি স্বার্থ সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণী কমিটিতে থাকা প্রতিনিধিদের টার্গেট করতে পারে এবং একটি বিল ফ্লোর ভোটে গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সদস্যদের ওপর দৃষ্টি ফেলতে পারে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং কৌশল শনাক্ত হয়ে গেলেই চ্যাটজিপিটির মতো এআই চ্যাটবট সেই ব্যক্তি ও কৌশলের সঙ্গে সংগতি রেখে এমনভাবে টেক্সট তৈরি করে ফেলতে পারে যা চিঠি, মন্তব্য বা নানা কিছুতে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে শনাক্ত করা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তখন মানব লবিয়িস্টও সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন।
একটি নেটওয়ার্কের মধ্যে থাকা কর্মকর্তাদের সক্ষমতা ও প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারার ক্ষমতা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এটি দিয়ে হ্যাক করা এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করা সম্ভব হবে।
নীতি নির্ধারণী ব্যবস্থার ওপর আক্রমণ করার উদ্দেশ্য এত জোরালো; এই ধরনের সিস্টেমকে প্রশিক্ষিত করতে প্রয়োজনীয় ডেটার সহজপ্রাপ্যতা এত অবাধ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে শনাক্ত করা এত কঠিন যে, যৌক্তিকভাবেই মনে হচ্ছে, আইনপ্রণেতাদের বেছে বেছে টার্গেট করা হবে। দিন যত যাবে ততই এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রশিক্ষিত হবে। আর ততই গণতন্ত্র ঝুঁকিতে পড়বে।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত।
-
নাথান ই. স্যান্ডার্স হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কম্যান ক্লেইন সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত একজন তথ্য বিজ্ঞানী
-
ব্রুস শ্নেইর একজন নিরাপত্তা প্রযুক্তিবিদ ও হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের প্রভাষক